আ’কাল’চ্ছে দিন।

রাত তখন বারোটা ছুঁই ছুঁই। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় সেমিস্টার শুরু হতে না হতেই ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্টের চাপে বাচ্চাগুলো জর্জরিত। ক্লান্ত শরীরে পরের দিনের ক্লাসের প্রস্তুতি মাথায় নিয়ে শুতে যাওয়ার পালা। হঠাৎ, ক্লাসের গ্রুপে মেসেজ। আমাদেরই এক সহপাঠিনীর বাবার করোনার কিছু লক্ষণ দেখা গিয়েছে। দেখা যেতেই কয়েক ঘন্টার মধ্যে অক্সিজেনের মাত্রা ওঠা নামা করতে শুরু করে দিয়েছে। কলকাতার বিটি রোডের লাগোয়া এক ফ্ল্যাটবাড়িতে তাদের বসবাস। কিন্তু অত রাত্রে অসহায় হয়ে সে গ্রুপে জানিয়েছে।
আমরা মোট সাতচল্লিশ জন। গ্রুপে মোটামুটি সবাই তখন জেগে। শুরু হল অক্সিজেন খোঁজার কাজ। ফোনের পর ফোন করে যাচ্ছে বন্ধুরা। উত্তর কি মিলছে জানেন? হয় “আগে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করুন”, নাহলে “স্টকে নেই।” আমাদের সাতচল্লিশজনের মোটামুটি কেউ না কেউ ডাক্তার চেনাজানা পরিজন আছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও লাভ হচ্ছে না। হন্যে হয়ে ততক্ষণে খোঁজা হচ্ছে একটা সিলিন্ডার। কেবলমাত্র একটা। ভাবুন, সাতচল্লিশ জন রাত সাড়ে বারোটায় একটা সিলিন্ডার পাচ্ছে না। 
ফোনের পর ফোন করা হচ্ছে। হোয়াটস আপে যেই নাম্বারগুলি দিয়ে মেসেজগুলি ছড়ানো হচ্ছে, আমার সহপাঠী-সহপাঠিনীদের মাত্র দু’ঘন্টার অভিজ্ঞতা, ফোন বেজে যাচ্ছে, তুলছে না, ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না, নাহলে তারা প্রতারক। কালোবাজারি চলছে, আগে কয়েক হাজার তারপর অক্সিজেন। মানবিকতা যেন এক বিলাসিতা। রাজনৈতিক দলের লোক, পরিচিত ডাক্তারের নাম, কিছুই কাজে লাগেনি। হন্যে হয়ে যখন আমরা পাচ্ছিনা, জানানো হল অধ্যাপকদের। রাত তখন প্রায় দুটো। বিভাগের সকল অধ্যাপকের সাহায্যেও মিলেছে কিছু নম্বর, কিছু নাম।
চেষ্টা তখনও জারি আছে।
রাত প্রায় তিনটে। অবশেষে মিললো, একটি সিলিন্ডার। হয়তো ক্ষণিকের স্বস্তি পাওয়া গেল। কিন্তু ভেবে ভয় পান প্রতি সেকেন্ডে, প্রতি মিনিটে কত মানুষ একটা সিলিন্ডারের খোঁজ করছেন। প্রায় সাতান্নজনের প্রচেষ্টায় মিললো একটা সিলিন্ডার। এটাই দেশের অবস্থা। এটাই রাজ্যের অবস্থা। তবু চলছে মিছিল। তবু বন্ধ নেই জনসভা। তবু মানুষ গণতন্ত্রের উৎসবে মেতেছে। এক শোষক থেকে অন্য শোষকের কাছে আত্মসমর্পণ করতে।
“মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।”
মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারবে যদি এই মুহূর্তে আমরা দূরে দূরে থাকি। প্রয়োজনে ‘বেঁধে বেঁধে’ থাকবো। কিন্তু, মানুষ যে বড় নিষ্ঠুর প্রাণীও বটে।নিজের জাতিকে সংকটে দেখে উল্লাস চলছে, তবে নিজের মানুষকে সংকটে দেখে মানুষ ভয় পায়।
সতর্ক হোন, পরিবার পরিজনদের বাঁচান। আপনি না থাকলে এই গণতন্ত্রের কিছু এসে যাবে না। তবে পরিবারের এসে যাবে। এটাই বাস্তব। স্বপ্ন দেখবেন না, বাস্তবের মাটিতে পা ফেলে বুঝুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *