“দিনের আলোয় কাটে অন্ধকার…”

ছোট্ট ছেলে, নাম তার প্রসাদ। উত্তর কলকাতার ১০০ গড়পার রোডের এক বাড়ির ছোট্ট ছেলে সে।
ঠিকানাটা চেনা হলেও নামটা ঠিক চেনা যাচ্ছে না, তাই না? নাম চেনা যাবে, কারণ এর পরেই তার নামকরণ করা হয় সত্যজিৎ। হ্যাঁ, দিগ্বিজয়ী সত্যজিৎ। স্থিরচিত্র, চলচ্চিত্র, ক্যামেরা, তুলি, পেন, সবকিছুকেই বশিকরণ করার ক্ষমতা যেন দিয়েছিলেন তাকে মা সারদা। ১৯২১ সালে এই দিনেই প্রখ্যাত রায় পরিবারে যার জন্ম, যার বাড়ির আবহাওয়ার সঙ্গে মিশে ছিলেন ঠাকুরদা  উপেন্দ্রকিশোর, বাবা সুকুমার। কিন্তু, সুখ মানুষের কপালে বেশিদিনের জন্য থাকে না। দু বছর বয়সেই পিতৃহারা ছেলেকে নিয়ে দিকভ্রান্ত তার মা সুপ্রভা দেবী। ইউ রায় এন্ড সন্স ততদিনে দেউলিয়া ঘোষিত হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে মা উঠলেন বেলতলা রোডের মামারবাড়িতে। আট বছর বয়স থেকে শুরু হল প্রাথমিক শিক্ষা, বালিগঞ্জ গভর্মেন্ট হাই স্কুলে। একা এই পথচলায় মা-ই একমাত্র সঙ্গী। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে সত্যজিৎ তখন প্রেসিডেন্সিতে অর্থনীতির ছাত্র। সেই সময় থেকেই সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রের প্রতি এক অদ্ভুত টান তিনি অনুভব করেন। গ্রাজুয়েশন শেষ করে পাড়ি দেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনে। কিন্তু সেখানের পড়াশুনো অসম্পূর্ণ রেখে তিনি ফিরে আসেন কলকাতায়। চিত্রনাট্য ও রংতুলির জগতে মনোনিবেশ করেন সত্যজিৎ। পথের পাঁচালী থেকে আগন্তুক মৌচাক পত্রিকার প্রচ্ছদ থেকে আম আঁটির ভেঁপুর প্রচ্ছদ তিনি আঁকতে শুরু করেন। এরপর মাকে নিয়ে লেক এভিনিউয়ের একটি বাড়িতে গিয়ে ওঠেন তিনি।
শুরু হয় দেশ বিদেশের পরিচালক ও অভিনেতাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয়।
সত্যজিৎ তখন বিবাহিত, সন্তান পালনের পাশাপাশি কাজ চলছে পুরোদমে। সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়ে পর্দায় দর্শকদের সামনে আসে পথের পাঁচালী , ১৯৫৫ সালে নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টে। পরে কলকাতায় তা মুক্তি পায়। এরপর তাকে আর পিছনে ফিরতে হয়নি, একে একে অপরাজিত, তিনকন্যা, চারুলতা, নায়ক, পরশপাথর, ঘরে বাইরে,গুপী গাইন বাঘা বাইন, তাক লাগিয়ে দেয় বাঙালি, ভারতবাসী, তথা বিশ্ববাসীকেও। ক্যামেরার চোখ, নিঃশব্দতা, অভিনেত্রীর চাহনি, সংগীত, আবহসংগীত, কিভাবে তার ছবিতে তিনি ব্যবহার করতে চান, সেই বিষয়ে ছিলেন অত্যন্ত খুঁতখুঁতে। শিখেছিলেন প্রাচ্যের চলচ্চিত্রে কিভাবে পাশ্চাত্যের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে নতুন কিছু ভাবানো যায়। তাই প্রতিটি ব্যাপারে নিখুঁত প্ররিস্থাপন ছিল তার নিজের সাথেই নিজের এক প্রতিযোগিতা।
শুধু চলচ্চিত্র কেন, বাঙালি ক্ষুদ্র থেকে বৃদ্ধ পাঠকজনের কাছে তার ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কুও সমাদৃত। দেশ বিদেশ ভ্রমণ, পদ্মশ্রী থেকে অস্কার, বাঙালি আজও তার গর্বে গর্বিত।
বাঙালি বড় আবেগপ্রবণ। রবীন্দ্রনাথ এবং সত্যজিৎ, এই দুজনকে নিয়ে সবসময়ই দুর্বল তারা। আমার মামাবাড়িতে বাংলা সিনেমার হাতেখড়ি হয় এই হীরক রাজার দেশে দিয়েই। বাঙালি বাড়িতে তখন সিডি আসেনি। রবিবার দুপুরে আমাদের ভাই বোন তথা অপু দুর্গার এক রুটিন ছিল। একটা ভূতের রাজাও ছিল, আমার মামা। তারস্বরে যখন ভাই আর আমি গাইছি “ভূতের রাজা দিল বর, জবর জবর তিন বর” তখন মামা হয়তো আমাদের হাতে দিয়ে যাচ্ছে ফেলুদার বই। ক্লাসের বইয়ের ফাঁকে কেমিস্ট্রির বোঝা কমাতে আমি মুকুলের সাথে ঘুরেছি সোনার কেল্লায়, ফেলুদার সাথে গিয়েছি বোম্বাই। কলেজের ক্লাসে শ্রুতিদি বুঝিয়েছেন চারুলতার শেষ দৃশ্যের স্থিরচিত্রের অর্থ। দূর থেকে মনে হয় ভাঙা সংসার জোড়া লাগে, কিন্তু কাছে গিয়েও বোঝা যায় সে ভাঙনের পরে দুই হাত মিললো কি মিললো না। তার চিন্তাধারা বুঝতে পড়েছি তার ইন্টারভিউ। হতাশ হয়েছেন, ফতুর হয়েছেন, তবু হাল ছাড়েননি তার আশা আকাঙ্খাকে বাঁচিয়ে রেখে গিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। আজ থেকে শত বর্ষ পরেও পাঠকের কাছে হয়তো অস্তিত্ব থাকবে সেই নিশ্চিন্দিপুরের, সেই হীরক রাজ্যের। হয়তো শঙ্কুর কল্পরাজ্য তৈরি হবে বাস্তবে, মহারাজও খুশি হবেন। আজ তার জন্ম সার্ধশতবার্ষিকী। বাঙালি আজও নিশ্চিন্দিপুরের ঘ্রাণ নিচ্ছে তার পথের পাঁচালী থেকে, মানুষ আজও ব্যথিত হয় সর্বজয়ার কান্নায়, বাঙালি আজও স্তম্ভিত হয়  গুপী বাঘার গানে, পাঠক আজও চারমিনারের হাতে ফেলুদা হতে চায়।
এ তো গেল মর্ত্যের কথা, তবে সত্যজিৎ বাবুর স্বর্গরাজ্যে ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে শ্যুটিং… ফেলু,জটায়ু, পরিচালকের ট্রিলজি।
” অ্যাকশন।”
হ্যাপি সেঞ্চুরি মহারাজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *