‘সিগারেট’

–দাদা, হাতটা সরিয়ে একটু চেপে বসুন প্লিজ।
— আর কত চাপব দিদি?
ভদ্রলোক মুখে ছদ্ম হাসি সাজিয়ে, অবাঞ্ছিত ছড়ানো কনুই আরোও কয়েক ডিগ্রি বাঁকিয়ে দিলেন, আমার দিকে। কোনোও অভিযোগের সুযোগ না দিয়ে অন্যমনস্কতার ভান করে ফেবুতে মন দিলেন। পাশের মোটা ভুঁড়িওয়ালা ভদ্রলোক আর এক অবতার। হাত মেলে দিয়েছেন-পেছনে। এ যেন তার শখের উন্মুক্ত বাগিচা। বিরক্তির ভাব টেনে, একদৃষ্টে তাকাতেই নির্লজ্জ হাসি দিয়ে হাই তুললেন। শরীরের ভঙ্গিমা, ভাষায় রুপান্তর করলে দাঁড়ায় –
“ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোটো সে তরী,
আমারই ভুঁড়ির ভারে গিয়েছে ভরি “।
অটোতে এমন স্পিসিস প্রায়ই জুটে যায়৷ অবাক হই না। এসব সময়, কানে হেডফোন গুঁজে বিচরণ করি নিজস্ব নোম্যান্সল্যান্ডে। যেদিন এসব প্রাণীর অত্যাচার অসহনীয় হয়ে ওঠে, আমারো নিরুপায় কনুই স্লিপ খেয়ে গুঁতো মারে বিপরীতে। বত্রিশ পাটি শো কেস করে মিষ্টি হাসি। কখনো বা সরি। কখনো বিব্রত হওয়ার অভিনয় করে জিতে নিই স্টেজ। আবার কখনো খেলা হয়ে যায়- ‘ওপেন আক্রমণ’।
ভ্যাবলা কাকু ক্যাবলা হেসে কনুই কাত করবেই! আমিও উল্টোদিকে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তা চেপে ধরবোই। এমনই নীতিতে চলন্ত অটোতে- বহুবার বাহুবলের পরীক্ষা দিয়ে সফল ‘বাহুবলী’ রুপে উত্তীর্ণ হয়েছি।

মাঝেমধ্যে, অটোগুলোকে জলজ্যান্ত ক্যাপিট্যালিস্ট কমোডিটিও মনে হয়; শুধুই চেপে ধরতে চায়। ভিতরে জায়গা দখল করতে চাওয়া মানুষগুলো- ইমপিরিয়ালিস্ট। রোজকার এসব ছোটোখাটো অভিজ্ঞতা সোশ্যালিস্ট থিওরি বোঝার জন্য উপযুক্ত। এসবই ভাবতে ভাবতে পথ কেটে যায়। অটোর ট্রিপ শেষ করে বাটার মোড়ে নামলেই তৃপ্তি। আর কিছুটা পেরোলেই কলেজ স্ট্রিট। ইউনিভার্সিটি। আমার প্রাইসড পোজেসন। এই ভেবেই ফুটপাথের গতিশীল মানুষের রাশি রাশি উন্মাদনা ভেদ করে এগিয়ে যাই – গন্তব্যের দিকে।

আমাদের কলেজস্ট্রিট কলকাতার বুকে বইরাজ্য; মা সরস্বতীর কিংডম৷ এখানে, সকাল দশটার পরবর্তী সময় থেকেই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে- সর্পিল কিউ। বই ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে অবিরত চলমান ব্যক্তিগত মান-অভিমানের মামলা। নাটকীয় সংলাপ। বিনয়ের বিনিসুতোয় গাঁথা দরদামের বহর- দাদা, গেট আপটা দেখুন। হাতে নিয়ে দেখুন। পাতাগুলো ছুঁয়ে দেখুন। এ জিনিস অন্য কোথাও পাবেন না। না দাদা! ক্ষমা করবেন; আপনার থেকে এমন আশা করিনি।
ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে, যানবাহনের ক্যাকফনির ব্যাকগ্রাউন্ডস্কোর সহযোগে- এইসব লাইভ পার্ফম্যান্স দেখছিলাম। এমন সময়, পেছন থেকে টোকা দিয়ে আমার নির্মল রসাস্বাদনে বিঘ্ন ঘটাল সুপর্ণা।
“এত্ত হাসি কীসের ভাই? মন কোথায়?”
প্রশ্নর সাথে সঙ্গত দিয়ে ওর ভ্রুজোড়া ধাধিনা-নাতিনা করে নেচে উঠল। ভদ্রতার খাতিরে,আমিও মুখে- হাসির বহমান পানি সাজিয়ে কাটিয়ে দিতেই যাচ্ছিলাম;তারই মধ্যে পাল্টা প্রশ্ন-
“আবার পেরেম টেরেমের কেস নাকি হে”?
ব্যাস! দৃশ্য বদল। আবহাওয়া পরিবর্তন। বিদ্যুদ্বেগে সর্বশরীরে ক্রোধ সঞ্চার করল। দমন করে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। হাসির আভা বজায় রেখেই বললাম-
” ইউনিভার্সাল সব ক্রাইসিসে কি প্রেমই সমাধান? জীবনে কি আর কিচ্ছু নেই”?
সুপর্ণার ভ্রু এবার ধনুক আকার নিয়ে স্ট্যাটিক। চোখ চশমার কাঁচ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে আমার দিকে-
” কেন ভাই! কিছুদিন আগে অবধিও তো, ফেবুতে- প্রেমিকের সাথে প্লেটোনিক প্রেমের নগমা দিয়ে চারপাতার প্রবন্ধ নামালি! ভুলে গেলি এর মধ্যে”?
নির্বাক ও নিরুত্তর আমির চোখ তখন সাইলেন্স ল্যাম্বের হ্যানিবাল। আমার তত্ত্বকথার পান্ডুলিপি খুলবো; এমনই দুর্ঘটনার আঁচ পেয়ে বিষয় বদলেছে সুপর্ণা। চলে গেছে- কালকের রুবেয়া ম্যামের ক্লাসে।
-“আরেহ! রেগে যাচ্ছিস কেন? আসলে প্রেমের কথাটা এসেছে, তোর ঐ পাবলো নেরুদার প্রেমের কবিতার অনুবাদ থেকে। রুবেয়া ম্যাম কত প্রশংসা করলেন তোর!তাই…” এমন গুলতাপ্পির সমীকরণই আশা করা যায় ওর থেকে। কাঁধে হাত রেখে মিছিমিছি দোস্তানার ভঙ্গি করল সুপর্ণা।আমি চট করে ঘড়ি দেখে বললাম-
” ক্লাস আছে, যেতে হবে”। সুপর্ণা নাছোড়বান্দা। গতিতে হেলদোল নেই। আমার যাওয়ার তাড়া দেখে,নিজের গতি আরোও কিছুটা কমিয়ে শুরু করল- আমার ইতিবৃত্তের চিরুনিতল্লাশী৷
” রুবেয়া ম্যাম তোকে তো খুবই পছন্দ করেন। তোদের ঐদিকেই থাকেন। তোরা কি আত্মীয় টাত্মীয় কোনভাবে হস?” কয়েক মিলিসেকেন্ড বিরক্তিতে হাবুডুবু খেয়ে সজাগ হলাম।ওর দিকে ঘুরে কোমরে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
” আত্মীয়? কীভাবে”?
একটু অপ্রস্তুত হওয়ার ভঙ্গিমা করে জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে নিয়ে বলল-
” ইয়ে, মানে…আমার বাড়িতে বলে, তোদের এত্ত বাচ্চাকাচ্চা হয়, যে পরবর্তীকালে কেউ না কেউ কারোর আত্মীয় হয়েই যাস”। নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করে বললাম- ” এটা ২০২০ সাল। একটু চারপাশে খোঁজখবর রাখ”।
এর বেশি কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করিনি।সময় নষ্ট না করে হাঁটা লাগালাম, তীব্র গতিতে। কলেজ স্কোয়ারের সামনে আসতেই আবার ডাক পড়লো-
“আলিফা! দাঁড়া,দাঁড়া। প্লিজ দাঁড়া। তোকে আসল কথাটাই বলা হয়নি”। ঘড়ি দেখিয়ে ইঙ্গিত করলাম- ‘পাঁচ মিনিটে ক্লাস শুরু, দু-মিনিটে কথা শেষ কর’।
বলাই বাহুল্য, দু-মিনিটে সুপর্ণা আমার অতীত নিয়ে একখানা গিমিক রচনা করল। তার আগে, ব্যাগ থেকে মিকি মাউস আকারের বোতল বের করে- মুন্ডু খুলে জল খেল। এরপর, নিজের প্রাণের আরাম ঘটিয়ে আমাকে হারামের দিকে ঠেলে দিল…
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল-
” বুঝলি, কাল সেন্ট্রাল মেট্রো থেকে বাড়ি ফেরার জন্য, মেডিক্যাল কলেজের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলাম”। এই বলেই একটা নাটকীয় পজ। যেমন থাকে সংলাপে- সাসপেন্স তৈরি করতে। আমি ঢোক গিলে বললাম-
“কী হয়েছে কী মেডিক্যালে?”
আমার অস্বস্তি আন্দাজ করেই চশমার ফাঁক দিয়ে টুক করে দেখে নিল। তির্যক হেসে বললো-
“কী আবার হবে? মেডিক্যালের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি, যেতে যেতেই উল্টোদিকের রেলিঙে চোখ চলে গেল! দেখি একজোড়া কপোত-কপোতী! কী প্রেম! একেবারে মশগুল”!
আমার শ্বাস-প্রশ্বাস তখন সপ্তকে। নিরুত্তাপ হওয়ার চেষ্টা করে বললাম – ” হুম”। আমার নির্বিকার এক্সপ্রেসনে একটুও না দমে সুপর্ণা বললো-
” কী ডেডিকেশন মাইরি! তারপর দেখি, দুজনেই এ্যাপ্রন পরে বসে আছে, মানে দুজনেই ডাক্তার”! এবার আমি কিছুটা ভারি বোধ করলাম। কি কথা আসতে চলেছে তা আন্দাজ করেই হাটা লাগিয়েছি, সুপর্ণাও পাশে পাশে। আমি যত জোরে পা চালাচ্ছি ও ততোধিক জোড়ে মুখ; আমায় প্রতিহত করতে।
-” ভাই, ভাবতেই পারিনি, এই দশদিনের মাথায় কীভাবে একটা নতুন প্রেম জুটিয়ে ফেলল তোর বয়ফ্রেন্ড! ইয়ে, থুড়ি,তোর এক্স”। আমি একটুও আস্কারা না দিয়ে চোখ চালাচ্ছি দিকবিদিক। আজ রাস্তায় আয়েষা,উজান কেউ নেই! পাশে সুপর্ণার মনোলগ চলছে তো চলছেই…
” বলিহারি বটে! ডাক্তারদের এইসব ইমোশন টিমোশন কিস্যু নেই। ভেরি স্যাড”! বলেই মুখে ন্যাকা ন্যাকা চুঁচুঁ শব্দ করে আমার মাথা ধরিয়ে দিল।
আমার হাটার গতি এতই বেড়ে গেছে যে শেষে হাঁপাতে শুরু করেছি। মনে হচ্ছে, শরীরে কেউ অজস্র পিন ফুটিয়ে পরিহাস করছে আমার উপর। রাস্তার ট্রাফিক কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে, চেনা-অচেনা মুখগুলো একই রকমের হয়ে উঠছে। এমন সময় পেছন থেকে একটা পরিচিত গলা ভেসে এল-
“আলিফা”! অর্চি ডাকছে। সাথে আয়েষা,উজান।
ইউনিভার্সিটি থেকে কয়েক কদম আগেই সিগারেটের দোকান থেকে আজকের প্যাকেট তুলে রাখছে ওরা। দূর থেকে আমার সাথে সুপর্ণাকে দেখে যে যার নিজস্ব স্টাইলে ভ্রু কুঁচকে ফেলেছে।আমি পৌঁছানোর আগেই বিস্ফারিত গলায় অর্চি বলে উঠলো-
” কীরে! ঐ গরুচোরটার সাথে কী করছিস”?
‘গোরুচোর’ আমাদের পেটেন্ট ডায়ালগ। অর্চির থেকেই আমদানি করেছি সবাই। আমি ওদের সাথে সিঁটিয়ে গেছি।
সুপর্ণা আড় নজরে তাকিয়ে, বিষাক্ত পোকার মতোই ল্যাতপ্যাত করে ঢুকে গেল ইউনিভার্সিটি। আমার বন্ধুরা সিগারেট ধরিয়েছে একটা। দিনের শুরুতে, বাতাসের সাথে ধোঁয়া হয়ে মিশে যাচ্ছে পাঁচ আনার সব দুঃখ, অপমান, বিষাদ। আমি ধোঁয়ার থেকে কিছুটা ফারাকে দাঁড়িয়ে আফসোস করছি- কেন যে আমি ওদের মতো সিগারেট খেতে পারিনা, কে জানে!


-রাকিবা সুুুলতানা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *