রাষ্ট্রের হাত থেকে এয়ার ইন্ডিয়া টাটার হাতে যেতে আর এস এস উৎফুল্ল কেন?

ভারত সরকারের অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা সঞ্জীব সান্যাল জানিয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বলে যেগুলো এতদিন দাবি করে আসা হয়েছে। সেগুলি সবই আসলে পুঁজিপতির সম্পত্তি, তাদেরই অবদান। টাটার হাতে এয়ার ইন্ডিয়া যাওয়ার পরে বিজেপি শিবির দারুণ উৎফুল্ল। টাটা কোম্পানি নাকি দেরীতে হলেও সুবিচার পেয়েছে।

সঞ্জীব বাবুর কথাটা মোটেও মিথ্যা নয়। ভারতে জাতীয়করণ হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্র তৈরী হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র থেকে গেছে পুঁজিপতিদেরই হাতে। তাই ১৯৪৫ সালে বম্বে পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে যখন ভারতের প্রতিটি উঠতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী পুঁজিপতি বাজার অর্থনীতির উপর আস্থা রাখতে পারলেন না। জামশেদজী টাটা, বিড়লারা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে স্বাধীন ভারতে শিল্প মূলত গড়ে উঠবে সরকারী বিনিয়োগে। সরকারকেই বিনিয়োগ করতে হবে। ১৫ বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা শিল্পে বিনিয়োগ করার কথা বলা হয়। ফলে মিশ্র অর্থনীতির যে মডেল ভারতে গড়ে উঠলো তা নিয়ে জামশেদজীদের আপত্তি হওয়ার কথা নয়। সঞ্জীব স্যান্যাল কি তা ভুলে গেছেন? উপরন্তু বিনা পয়সায় টাটা বিমান কেড়ে নেওয়া হয়নি। প্রায় তিন কোটি টাকা দিয়ে নেহরু তা কিনেছিলেন।

তখন দিল্লি থেকে মুম্বই-এর প্লেনের টিকিটের দাম ছিল ১৫০ টাকা। এখন ন্যূনতম তার পঁচিশ গুণ বেশী। উপরন্তু ঠিক যেই কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রের কাঁধে ভর করে নিজেদের পায়ের তলায় জমি শক্ত করার পরিকল্পনা টাটা-বিড়লাদের ছিল। সেই আশাও বিফলে গেল না। জামশেদজীকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বিমান কম্পানির ম্যানেজার পদে বসানো হল। কুড়ি বছরের জন্য। এটাই ছিল এবং এখনও আছে সাধারণ ফর্মূলা। রাস্ট্রায়াত্ত কোম্পানিকে দুইয়ে নিতে হবে। তার ম্যানেজার হিসেবে নিজের লোক বসানো বা ম্যানেজারকে কিনে নেওয়া। ঝরিয়া কয়লা খনি থেকে টিসকোতে কয়লা পাচার হতে পারতো না খনির আধিকারিকদের সাহায্য ছাড়া। রাষ্ট্রায়ত্ব ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা নিজের বরাত ছেড়ে দিয়ে বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানাকে সেই বরাতই পাইয়ে দিতে পারে না রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রের আমলার সাহায্য ছাড়া। জাতীয়করণ টাটা-বিড়লাদের শক্তিশালী করেছে। রাষ্ট্রই এই কাজে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসাবে তাদের সাহায্য করেছে।

অনির্বাচিত আমলাতন্ত্র, চারিদিক থেকে রক্ষা করেছে তাদের। নির্বাচিত মন্ত্রীরাও নিশ্চিন্তে দুর্নীতি করে রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়াকে রুগ্ন করেছে। ফলে সঞ্জীব বাবু অর্ধসত্য বলছেন। জাতীয়করণ হলেও সব ছিল তাদেরই, আজও তাদেরই। আর তাই নিশ্চিন্তে তারা নিজেরাই জাতীয়করণ চেয়েছিল। কারণ তারা জানতো যে এই জাতীয়করণ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জাতীয়করণ নয়। যেখানে ভারী শিল্পে বিনিয়োগের অধিকার নেই কোনো বেসরকারি পুঁজির। যেখানে রাষ্ট্রটা অনির্বাচিত আমলাতন্ত্রের দ্বারা পরিবেষ্টিত ক্ষুদ্র নগন্য সংসদ-বিধানসভা নয়।

সান্যালবাবুর এটাও জানার কথা যে কুখ্যাত বৃটিশ ইম্পিরিয়াল এয়ার-ওয়েজের হয়ে চিঠি-সার্কুলার ইত্যাদি আদানপ্রদানের বরাত জুটিয়েছিলেন জামশেদজী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও টাটা যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়। এই বিমান সংস্থা বৃটিশদের জন্য সৈন্য অস্ত্র বহন করে। আর এর সঙ্গে ফ্যাসিবাদবিরোধিতার যে কোনো সম্পর্ক নেই তা বলাই বাহুল্য। জার্মানি জিতলে তাদের হয়েও একই কাজ টাটা করতেন। এহেন ‘দালালির’ চিহ্নকে বিনা ক্ষতিপূরণে কেন কেড়ে নিলেন না প্রধানমন্ত্রী নেহরু? আসলে ‘ইংরেজদের’ ভারতকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে, দেশের জাতীয়করণ হয়েছে তাতেই আফশোষের শেষ নেই আরএসএস-এর।

পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে জাতীয়করণ করে ১৯৫৩ সালেও টাটাদের লাভ হয়েছিল, আজও ওদেরই লাভ হল। এয়ার ইন্ডিয়ার বেসরকারিকরণের হুজুগ তুললেন বাজপেয়ী। ২০০০ সালেই ক্ষতি হল এয়ার ইন্ডিয়ার। শেষে আজ সরাকারি কোষাগার উপুর করে ৩০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে সংস্থাকে চাঙ্গা করা হল। এখন মাত্র ১৫ হাজার কোটির ঋণের বোঝা স্বীকার করে আর আড়াই হাজার কোটি দিয়ে টাটা পেয়ে গেলেন এয়ার ইন্ডিয়া। পাতাল আম্বানীকে দেওয়া আছে। জল-বন্দর-ড্রাগ আদানিকে। এখন আকাশ পথ দেওয় আহল টাটাকে। আশঙ্কা এই ১৫ হাজার টাকারর ঋণের বোঝা আবার সেই রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যংকগুলির ঘাড়েই চাপাবে টাটা-মোদী জুটি। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *