আড়াই লক্ষ গাছ ও জল সংকটের সম্ভাবনায় বক্সা জঙ্গলে বিড়লাদের প্রস্তাবিত হীরের খনির বিরুদ্ধে জনমত বৃদ্ধি পাচ্ছে

মধ্যপ্রদেশের সংরক্ষিত বক্সা জঙ্গলকে হীরে উত্তলনের জন্য আদিত্য বিড়লা গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে খুব ধীরে হলেও একটা প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে উঠছে। মধ্য ভারতের বুন্দেলখন্ডের সংরক্ষিত বক্সা জঙ্গলের ৩৮২.১৩ হেক্টর জঙ্গল আদিত্য বিড়লা গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব পাশ হয়েছে। জঙ্গল নির্মূল সংক্রান্ত রিপোর্টে এর ফলে ২,১৫,৮৭৫ টি গাছ কাটা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
৩৪ মিলিয়ন ক্যারট হীরে উত্তোলনের জন্য আদিত্য বিড়লা গোষ্ঠীর এসেল মাইনিং অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এই বরাত পায়।

মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপাল থেকে উত্তর পূর্ব দিকে ২৬০ কিমি দূরে ছাতারপুর জেলায় বক্সা জঙ্গলটি অবস্থিত। ১৭ টি আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামের প্রায় ৭০০০ গ্রামবাসীর রুটি রুজির একমাত্র ভরসা এই জঙ্গলটি। দুই লক্ষের বেশি গাছ কেটে ফেলার সাথে প্রস্তাবিত এই অঞ্চলের বাইরে আরও বৃহত্তর অঞ্চলের জঙ্গলের জন্যও এই প্রজেক্ট বিধ্বংসী হতে পারে বলে পরিবেশ ও অধিকার কর্মীদের অভিমত। মহুয়া, তেন্দুয়া পাতা, চিরঞ্জি, আমলা প্রভৃতির জন্য জঙ্গলে গিয়ে বিশাল সংখ্যক আদিবাসী মানুষের একমাত্র জীবন জীবিকা হলেও ছাত্তারপুর মুখ্য বন সংরক্ষণ অফিসার এক রিপোর্টে জানিয়ে দেন এই জঙ্গলের উপর কোনও আদিবাসীর জীবন জীবিকা নির্ভর করে না, তাই জঙ্গলের উপর আদিবাসী অধিকারের কিছু ব্যাপার নেই বরং জঙ্গল এরকম কোনও কোম্পানির হাতে তুলে দিলে তাঁরা খুশী হবেন।

এর আগে মধ্যপ্রদেশ সরকার ২০০৬ সালে হীরে উত্তোলনের জন্য অস্ট্রেলিয়ার খনি বহুজাতিক সংস্থা রিও টিন্টোকে বক্সা ৯৫৪ হেক্টর জঙ্গল তুলে দেওয়ার প্রস্তাব পাশ করে দিয়েছিল কিন্তু তখনও তীব্র প্রতিরো আন্দোলনের মুখে ১৪ বছর ধরে ৯০ মিলিয়ন টাকা খরচ করার পর কোম্পানিটি প্রজেক্ট বাতিল করতে বাধ্য হয় ২০১৬ সালে। ২০১৭ সালে নতুন করে ৯০ বিলিয়ন ডলারের দরপত্র আহ্বান করা হয় জঙ্গলের জায়গা কিছুটা কমিয়ে। ২০১৯ সালে বিড়লা গোষ্ঠী ৫০ বছরের জন্য লিজ পায় এবং তারপরেই দ্রুততার সাথে পরিবেশ, খনি, জঙ্গল ইত্যাদি সংক্রান্ত ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য দ্রুত কাজ করতে শুরু করে।

এই প্রজেক্টের জন্য ভয়াবহ পরিবেশ সংক্রান্ত ক্ষতির সম্ভাবনা আবার প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে। সমাজ কর্মী নেহা সিং সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থে এই প্রজেক্ট বন্ধ কোর্টে আবেদন জানিয়েছেন। আর এক পরিবেশ কর্মী পি জি নাগপান্ডে জাতীয় গ্রিন টাইবুনালের দ্বারস্থ হয়েছেন অসৎ পদ্ধতিতে হীরের খনির জন্য অনুমতি নেওয়া হয়েছে এই অভিযোগে সেই অনুমতি বাতিল করার আবেদন করেছে।

কোভিড পরিস্থিতিতে জন সমাগমের নিষেধাজ্ঞার জন্য প্রাথমিকভাবে এই হীরের খনির বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধতে অসুবিধা হলেও চিপকো আন্দোলনের ধাঁচে অনলাইন ক্যাম্পেইন দ্রুত দানা বাঁধছে। পরিবেশ প্রেমিরা গত মে মাসে #SaveBuxwahaForest ট্যাগ দিয়ে ট্যুইটারে প্রথম দশের মধ্যে ট্রেন্ডিং করলেও জাতীয় মিডিয়াগুলির এই আন্দোলনকে প্রায় ব্ল্যাক আউট করার জন্য নিত্য নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করছেন। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গেও এই আন্দোলনের ঢেউ এসে পৌঁছেছে। পশ্চিমবঙ্গের নারীবাদী বেশ কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি মেয়েদের হীরের প্রতি সম্ভাব্য দুর্বলতাকে আঘাত করতে একটি “#GirlsHateDiamond” ক্যাম্পেইন শুরু করেছেন। এইভাবে নারী আন্দোলন ও পরিবেশ আন্দোলনকে এক সাথে বাঁধার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এরকমই একটা ডাক হোয়াটসাপ ও ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়াচ্ছেন তাঁরা।

“দেশের খনিজ সম্পদ বহুজাতিকদের হাতে তুলে দেওয়ার যে চক্রান্ত চলেছে ধারাবাহিকভাবে তার বিরুদ্ধে লড়াইও চলছে লাগাতার। গোয়া থেকে বেদান্তকে তাড়িয়েছে সুপ্রীম কোর্ট। পরিবেশ বাঁচানোর লড়াই হচ্ছে। আদিবাসীদের অধিকার বাঁচানোর লড়াই হচ্ছে। কিন্তু মধ্যপ্রদেশের বক্সা জঙ্গল সাফ করতে বিড়লা-মোদী যে চক্রান্ত করেছেন তা রুখতে এবার মেয়েরা এক্কেবারে নিজস্ব এজেন্ডা নিয়েই লড়াইয়ে নামার সুযোগ পাচ্ছে। নারীমুক্তির ঝান্ডা ধরে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মেয়েদের গয়নার প্রতি লোভ নিয়ে মণিহারা লিখে গেছেন। গায়ে ফোস্কা ধরানো গল্প। মেয়েরা নাকি গয়না দেখলেই পাগলিয়ে যায়!! আমরা নাকি এমনই নাক কান কাটা যে একটু সোনা-রুপো-হীরে পেলেই বরের প্যাঁদানিও মিঠে লাগে। বয়ফ্রেণ্ডের চোখে সুন্দর হওয়ার জন্য নাকি আমরা এতই মরিয়া যে নানা রঙের গয়না কিনে ফেলি। বিশ্বজুড়ে ফ্যাশান ডিজাইনার, গয়না ডিজাইনার প্রাণপাত করছেন। মাফিয়া হীরে ব্যবসায়ীরা তাদের মোটা টাকা দিয়ে নিয়োগ করেছেন। দেশে দেশে ভিন্ন ভিন্ন রুচির ধনী মেয়েদের, ধনী হতে পারে এমন মেয়েদের, বিবাহ যোগ্যা মেয়েদের বাবা-মা-দের সন্তুষ্ট করতে তারা গয়না বানিয়েই চলেছেন। আর আজ আফ্রিকা, কাল বক্সা, পড়শু ব্রাজিলে মাটি খুঁড়েই চলেছেন, জঙ্গল ধ্বংস করেই চলেছেন।

আমরা মেয়েরা নাকি এমনই সেয়ানা যে ‘স্বর্গ সম উচ্চস্থানে থাকে যে পিতা আর স্বর্গের চেয়েও বড় যে মা’, তাদের ছেড়ে বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে, শ্বশুরঘরে যাওয়ার আগে নিজের বাবা মা-এর কাছ থেকে গুনে গুনে গয়না আদায় করতে ভুলিনা। আসলে ওটা পণেরই গয়না। তাই গয়নাওয়ালা বিজ্ঞাপনের সাহায্যে খুল্লম খুল্লা নোংরা অশ্লীল উপদেশ দেন, মেয়ে সন্তান হওয়া মাত্র টাকা জমানোর উপদেশ। মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমানোর এমনই সেন্টিমেন্ট যে দুস্থ কন্যা ‘দায়গ্রস্ত’ বাবাদের সাহায্য করার জন্য মানুষ মুখিয়ে থাকেন। অঞ্জলি জুয়েলার্স, তনিষ্ক থেকে শুরু করে কত সব নামী দামী গয়না ব্যবসায়ীরা সম্ভার সাজিয়ে বসে আছেন। সেই সম্ভারে আছে স্বাধীনচেতা মেয়েদের জন্য গয়না, স্বামী সোহাগীদের জন্য গয়না। আইবুড়ো ভাতের জন্য গয়না, সন্তান সম্ভবা মেয়েদের সাধের অনুষ্ঠানের গয়না, আবার গায়ে হলুদের গয়না। বক্সওয়াহা জঙ্গলের উৎখাত হওয়া আদিবাসী মেয়েদের মত গয়না। দেশে প্রতিটা ঘরই গয়নার ক্রেতা, কেউ সোনা-রুপোর, কেউ হীরের। কেউ বা সোনার জলের।

এত্ত বড় বাজার যেখানে, সেখানে খনির পক্ষে লোক পেয়ে যাবেন বিড়লা-মোদীরা। সমর্থন পেতে তারা নিশ্চয়ই ঘোষণা করবেন যে দেশে হীরের ভাণ্ডার পাওয়া গেলে আর আফ্রিকা থেকে তা আমদানি করতে হবে না। সেক্ষেত্রে দাম কমে যাবে হীরের। যে মেয়েটা এতদিন অনেক টাকা জমিয়ে শুধু সোনা নিয়েই ক্ষান্ত থাকতো, তারও বরাত ভাল থাকলে একটা দুটো হীরে জুটে যেতে পারে।

তাই এই লড়াইয়ের ভাঙন রুখতে মেয়েদের নামতেই হবে। হীরের গয়নার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতেই হবে। যাতে এখন থেকেই ওরা টের পায় যে ক্রেতা বাজারে ফাটল ধরেছে।

আমরা মেয়েরা আজ আর মণিহারার পেত্নী হতে রাজী নই। তিন লাখ ২০০-৩০০ বছরের পুরোনো গাছা কাটা হীরে চাই না। হাজার হাজার পশু পাখি খুন করা হীরে চাই না। আদিবাসী মানুষের পেটে লাথি মারা হীরে চাই না। বক্সাতে হীরে খনি চাই না, আফ্রিকা বা ব্রাজিলেও নতুন করে সোনা হীরের খনি চাই না। পুরোনো খনি একদিন নিঃশেষিত হবে, হীরের যোগান শেষ হবে, হোক না। ক্ষতি কী? এতো আর বক্সাইট নয় যে ‘চাই না’ তা বলা যাবে না! বক্সাইটের ক্ষেত্রে না হয় পরিকল্পিত অর্থনীতির সাহায্য নিয়ে, প্রয়োজনীয়তা হিসেব করবো। কিন্তু হীরে বিলাস দ্রব্য। না, এত ক্ষতি করে বিলাসিতা একদম চাই না।
এমন নয় যে মেয়েদের মধ্যে এই আকর্ষণ রক্তে মিশে আছে বা তা জন্মগত। এই আকর্ষণের জন্ম দেওয়া হয়েছে। তাকে ভাবতে শেখানো হয়েছে যে রূপই তার আসল সম্পদ। রোজগার নেই। সুতরাং সোনা হীরেই তার সুরক্ষা কবচ।
হীরেকে না বলার মধ্য দিয়ে রূপচর্চার ব্যবসাকেও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছি আমরা। শরীরকে সাজানো ভাল, কিন্তু তার জন্য রাজা জমিদারদের যুগে ফিরে যাওয়া ভাল নয়। যাদের অন্দরমহলের মেয়েরা ২৪ ঘন্টাই রূপচর্চা করে কাটিয়ে দিতে বাধ্য হতো। রূপ নিয়ে এত মাথা না হয় নাই ঘামালাম। চুলে পাক ধরুক না, চামড়া ঝুলে পড়ুক না। মুখে দাগ থাকুক। ‘বডি শেমিং’ এর বিরুদ্ধে আজকাল মেয়েরা সরব হচ্ছেন। ভাল। কিন্তু শরীর সাজানো নিয়ে মাতামাতি থাকবে অথচ বডি শেমিং থাকবে না , এটা একটু অন্যায় আবদার হয়ে গেল না? হ্যাঁ এটা ঠিক, ইন্ডাস্ট্রি যখন এখানে কাজও আছে । রূপচর্চার ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেন বহু মহিলা, স্বনির্ভর হন তারা। আবার এটাও সত্যি যে বিশ্বজুড়ে অস্ত্র ব্যবসা এবং ড্রাগ এর ব্যবসায় কর্মরত বহু মানুষ। ড্রাগ নিষিদ্ধ হলে বহু লোকের কাজ যাবে। তবে বিকল্প ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সরকারের। রবীন্দ্রনাথকে যখন টানাই হলো তখন বলতেই হয়, মেয়েদের কর্মের মধ্য দিয়ে নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠার কথা যে তিনি বলেছেন, তা যেন অস্বীকার না করি।

আসুন আওয়াজ তুলি, মেয়েরা বক্সার হীরে ঘৃণা করে।

girlshatebuxwahadiamonds

১) শ্রাবন্তী ঘোষাল, স্কুলশিক্ষিকা
২) বৈশাখী কুন্ডু, নাট্যকর্মী
৩) লিপিকা রায়, শিল্পী
৪)সংগীতা উকিল, graphic-designer
৫) বৈশালী দত্ত, সঙ্গীত শিক্ষিকা
৬) মধুমিতা মুখার্জি আইসিডিএস কর্মী
৭) পাবক শুদ্ধা ছাত্রী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
৮) পারভিন কাজী, নাট্য কর্মী
৯) নাজমা খাতুন, স্কুল শিক্ষিকা
১০) কোপাই ঋতি, ছাত্রী প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়
১১) সংযুক্তা নন্দী, small business enterpreneur
১২) জিনিয়া সুলতানা, ছাত্রী, নীলাচল ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সাইন্সেস
১৩) শ্রুতিপর্না নিয়োগী, গবেষক ছাত্রী
১৪) বন্দনা মুখার্জি, নাট্যকর্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *