পুঁটির বিয়ে – রুশতি কূজুর

আজ, ২০শে নভেম্বর, ২০২২, খবরের কাগজের পাত্র চাই কলামে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। পুঁটির জন্য পাত্র। অবশ্য পুঁটির বিয়ে গত বছরই হওয়ার কথা ছিল। পাত্রও রেডি ছিল। কিন্তু সব ভেস্তে দিয়েছিল লকডাউন। দিনক্ষণ পিছিয়ে গেলো, শেষে পাত্রও বাতিল হয়ে গেলো। উপায়ও ছিল না। পাত্র ছিল ইঞ্জিনিয়ার, বিদেশী কম্পানিতে। কিন্তু মহামারীর প্রথম ধাক্কাতেই চাকরি চলে গেছিল। পুঁটির বাবাকে পাত্রের বাবা আশ্বস্ত করেছিলেন। বলেছিলেন, অসুবিধা হবে না। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। কিছু না কিছু জুটে যাবে। জুটলো ঠিকই। কিন্তু অর্ধেক মাইনেতে। না, পুঁটির বাবা সোসাইটিতে মুখ দেখাতে পারবেন না। তারা হলেন সম্ভ্রান্ত বংশ। একসময় তার প্রপিতামহের অনুপ্রেরণায় সুকুমার রায় গল্প লিখেছিলেন। ফলে বিয়ে সমূলে নাকচ হয়েছিল।

এখন আবার সব স্বাভাবিক হয়েছে। এবার পুঁটির বাবা দ্বিগুণ উৎসাহে মেয়ের বিয়ে দিতে নেমে পড়েছেন। তাই খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে আজ। পুঁটির জন্য সুপাত্র চাই। বিজ্ঞাপনে রয়েছে পুঁটির নিখুঁত বর্ণনা— একমাত্র কন্যা। সুন্দরী, উচ্চতা ২৪ সেন্টিমিটার। ধবধপে ফরসা, শুধু লেজের ডগায় কালো ছোপ।

বিজ্ঞাপন দেওয়া মাত্র, ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-শ্রেণী নির্বিশেষে পাত্রের নাম ধাম জমা হতে লাগলো পুঁটিদের লেটার বক্সে। পুঁটির বাবাকে এবার খুব সন্তর্পণ এগোতে হবে। আগের পাত্রকে নাকচ করেছেন মাইনে কম হয়ে গেছে বলে। ফলে এবার হবু জামাইয়ের আয় পরখ করে নিতে হবে।

চটপট একটা তালিকা বানিয়ে ফেললেন হুলোবাবু। মেয়েকে নিয়ে কালই তিনি রওনা হবেন। না, ফোনে কথা বলবেন না তিনি। স্বচক্ষে দেখে আসবেন বাড়ির হাল হকিকত।

এদিকে হয়েছে কি, পুঁটিকে মন দিয়ে বসে আছে পাড়ারই এক ছোকরা হুলো। পুঁটির বিয়ে যেদিন ঠিক হয়েছিল দুই বছর আগে, সেদিনই সে কুমড়ো সেদ্ধ খেয়ে সুইসাইড করবে ঠিক করেছিল। কিন্তু কুমরো সেদ্ধ খেয়ে মরার বদলে, বমি করে সে এক বিশ্রী কাণ্ড। মরাও হল না, ওদিকে লকডাউনে তার রোজগারটাই বন্ধ হয়ে গেল। তার ছিল এক ট্যুরিস্ট কম্পানি। বেড়ালদের নিয়ে যেতো নানা তীর্থস্থানে। সকলেই জানে বিড়ালরা তপস্বী হতে চায়, তীর্থস্থানে ঘুরতে খুব পছন্দ করে। কিন্তু লকডাউনে ট্যুরিস্ট কম্পানি লাটে উঠেছে। পুঁটিকে বিয়ে করার সাধ সে ত্যাগ করেছে। এখন সে পাড়ায় পাড়ায় ঠ্যালায় করে মাছ বিক্রী করে, যেটুকু বিক্রী হয়না তা নিজে আর মা মিলে খেয়ে ফেলে। সারাদিন খেটে খেটে তার মনটাই অন্যরকম হয় এগেছে। সন্ধেবেলা নেশা করে এখন। এমনকি যেদিন পুঁটির বিয়ে ভেঙে গেল, সেদিনও সে যে খুব আনন্দ পেয়েছিল তা হলফ করে বলা যাবে না। কিন্তু আজ খবরের কাগজে ওর বিয়ের বিজ্ঞাপন দেখে আবার যেন মনটা হু হু করে উঠলো। দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় খেলে গেলো। যেমন ভাবা তেমন কাজ। পুঁটির বাবার মত সেও সম্ভাব্য পাত্রের তালিকা বানিয়ে ফেললো। বাবা মেয়েতে পাত্রের বাড়ি বাড়ি রওনা হওয়ার আগেই সে ফোন করে ফেলেছিল প্রতিটি পাত্রের বাড়িতে। তাদের জানিয়ে দিয়েছিল যে পুঁটি মেয়েটা ভারী ঠ্যাটা। মেনে মানিয়ে চলতে পারে না। ছোট বেলা থেকে সে পম্ফ্রেট আর ইলিশ ছাড়া খায় না, আর তাকে সে মাছ না দিলে সে বায়না জুড়ে দেবে। মেয়ের রোজগার করার ক্ষমতা নেই, কিন্তু খরচ করার শখ সতেরো আনা। এইসব শুনে কোন ভদ্র’লোক’ না ভয় পাবে!!
পরের দিন, ২১শে নভেম্বর, ২০২২, পুঁটি আর তার বাবা হাজির হল মিস্টার টিংকুর বাড়ি। এই পাত্র সরকারী কর্মচারী, ভালই মাইনে পায়। হুলোবাবু বাইরে থেকে ডাক দিলেন,

বাবাজীবন বাড়ি আছো?

পাত্র মুখ বাড়িয়ে বলে, আছি।

হুলো শুধোয়, লকডাউনে আয় কমেনি তো?

পাত্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কমেছে। আমার পরিবারের রোজগার অর্ধেক হয়ে গেছে। বাপের ছিল অফিস পাড়ার এক ভাতের হোটেল। লকডাউনে সেই ভাতের হোটেল বন্ধ হল, ফলে সংসারে এখন রোজগেরে একমাত্র আমি। অনটন শুরু হয়েছে। আপনি বরং ওই পাড়ার বংকুবাবুর কাছে যান। ওদের মিষ্টির দোকান, লকডাউনে বন্ধ হয়নি।

পুঁটির বাবা মাথা ঝাঁকিয়ে, গোঁফ নাচিয়ে, লেজ নাড়িয়ে পুঁটিকে নিয়ে চললো পাশের পাড়াতে বংকুর বাড়ি।

বাবাজীবন বাড়ি আছো?

বংকু মুখ বাড়িয়ে বললো, আছি।

বাবা বলে, লকডাউনে আয় কমেনি তো?

বংকু বলে, আমি তো এখন দোকান খুলছিই না। দোকান খোলা রেখে কি করবো? প্রথম ধাক্কাতে বালতি বালতি ছানা নষ্ট হয়েছিল। কিন্তু এবার খদ্দের কই? সকলেই হিসেব করে খরচ করছে। সন্দেশের স্বাদ এখন বাতাসা দিয়ে মেটাচ্ছে বেড়ালরা। আপনি বরং পাশের পাড়ার মংকুর কাছে যান। সে এক কারখানার মালিক। প্লাস্টিকের পুঁথি তৈরী করে। ওদের বাড়িতে রোজ ইলিশ মাছ আর পম্ফ্রেট মাছ রান্না হয়। ওখানে খোঁজ করুন। বলেই দরাম করে দরজা বন্ধ করে দেয় সে।

পুঁটির বাবা মাথা ঝাঁকিয়ে, গোঁফ নাছিয়ে, লেজ নাড়িয়ে পুঁটিকে নিয়ে চললো মংকুর বাড়ি।

বাবাজীবন বাড়ি আছো?

মংকু মুখ বাড়িয়ে বলে, আছি।

হুলো জিজ্ঞেস করে, লকডাউনে আয় কমেনি তো?

মংকু বলে, অবশ্যই কমেছে। কারখানা বন্ধ। আমার কাঁচা মাল আসে ট্রাকে করে। সব বন্ধ। শ্রমিকদের বসিয়ে মাইনে দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তাই কারখানা বন্ধ করে দিয়েছি। আগে বাড়িতে দুবেলা চার রকম মাছ হতো। এখন সপ্তাহে একদিন। তাও ইলিশ বা পম্ফ্রেট হয় না। আপনি বরং ওপাড়ার শংকুর বাড়ি যান। সে শপিং মলের মালিক।

অতএব পুঁটির বাবা মাথা ঝাঁকিয়ে, গোঁফ নাছিয়ে, লেজ নাড়িয়ে পুঁটিকে নিয়ে চললো শংকুর বাড়ি।

বাবাজীবন বাড়ি আছো?

শংকু মুখ বাড়িয়ে বলে, আছি।

বাবা বলেন, লকডাউনে আয় কমেনি তো?

শংকু বলে, আলবাৎ কমেছে। শুধু আয়, মান মর্যাদা সব খোয়া গেছে। ছিলাম আগে শপিং মলেরর মালিক। এই শহরে ছিল রাস্তায় রাস্তায় আমারই মল। এখন সেই ব্যবসা কিনে নিয়েছে মুকুশি ম্যাঁওয়ানি। আগে ছিলুম মালিক, এখন হয়েছি ওই ম্যাঁওয়ানিদের সাপ্লায়ার। রাগে দুঃখে ঘেন্নায় আর মাছই ছুঁই না। বাড়িতে মাছ আসেইনা। নিরামিষ খাই। আপনি বরং ঐ পাশের পাড়াতে যান। ওখানে থাকে আমারই বন্ধু ঝুংকু। সে এক মস্ত ডাক্তার। এই সময় তার রোজগার আকাশ ছুঁয়েছে। রোজ দুবেলা দেখি ইলিশের মাথা, কাঁটা ফেলে দিচ্ছে। ভাবুন, বেড়াল মাছ ফেলে দিচ্ছে! পেট টইটুম্বুর না হলে বেড়ালেরর বাড়ি থেকে মাছ ফেলা যায়?

সুতরাং পুঁটির বাবা মাথা ঝাঁকিয়ে, গোঁফ নাছিয়ে, লেজ নাড়িয়ে পুঁটিকে নিয়ে চললো ঝুংকুর বাড়ি।

বাবাজীবন বাড়ি আছো?

ঝুংকু মা মুখ বের করে বলেন, বাড়ি তো আছেই, কিন্তু শুয়ে আছে। খুব জ্বর, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, ছেলে বলছে ওকে নাকি মহামারী ধরেছে। আপনারা আর এখানে দাঁড়াবেন না। কে জানে কখন আপনাদেরও রোগ ছুঁয়ে দেয়! আপনি বরং পাশের পাড়াতে যান। ওখানে থাকে বেড়াল কুলের সবচেয়ে ধনী বিলাই গেটু । ওনার শুনেছি ডিজিটাল ব্যবসা। টীকা ব্যবসা। ওষুধ ব্যবসা।

বুঝতেই পারছেন, পুঁটির বাবা মাথা ঝাঁকিয়ে, গোঁফ নাছিয়ে, লেজ নাড়িয়ে পুঁটিকে নিয়ে চললো ভাইপোর বাড়ি।

কিন্তু একি!! বাড়ির বাইরে বিরাট লাইন কিসের?

লাইনের পিছনে দাঁড়ানো এক হুলোকে জিজ্ঞেস করে পুঁটির বাবা। বাবা, এ কিসের লাইন?

ছেলেটি খুব বিরক্ত হয়ে বলে, আপনি কোন গ্রহের বাসিন্দা দাদু? এতা রানারদের লাইন। আমরা রানার। রান করি, পিঠে খবর থাকে না থাকে খাবার। এখন এই কাজের খুব ডীমান্ড।

পুঁটির বাবা ভারী অবাক হয়ে ছেলেটির সামনে দাঁড়ানো এক মিষ্টি মেনীর দিকে ইশারা করে বলে, এই মেয়েটিও বুঝি রানার?

ছেলেটি এবার রেগে যায়, খিঁচিয়ে ফ্যাঁস করে ওঠে। বলে, মেয়েরা পারবে ওরকম দৌড়তে? এই মেয়ে আগে শংকু বাবুর শপিং মলের কর্মচারী ছিল। মল বন্ধ, সে এখন এই বিলাইগেটুর ব্যবসায় নাম লিখিয়েছে। খারাপ পথে নেমেছে। অনলাইনে নিশি কুটুম ডাকে। এভাবেই সংসার চলে ওর। এই লাইনে যত মেয়ে দেখছেন সকলেই এই কাজ করে। ঝিগিরি করারও উপায় নেই। এখন রোগের ভয়ে সকলেই ঝি ছাড়িয়ে দিয়েছে। প্রত্যকে নানারকম ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা থেকে ধার করেছিল। কেউ সেলাই মেশিন কিনেছিল, কেউ স্বামীকে একটা টোটো কিনে দিয়েছিল। এখন ওই সব ধন্ধন ব্যংক এসে বাড়িতে তাগাদা মারে, নোংরা ভাষায় গালাগাল দেয়। মেয়েগুলো পাগল হয়ে গেছে। যেভাবেই হোক রোজগার করতেই হবে তাদের।

এতক্ষণ পুঁটি একটা কথাও বলেনি। কিন্তু এবার সে বাবার লেজ ধরে কামড় মারে। চোখে আগুন। বাঘের মাসির মত লাগছে তাকে।

বাবা, আমি কিছুতেই এই টীকা ব্যবসায়ী, ওষুধ ব্যবসায়ী, ডিজিটাল ব্যবসায়ী, মৃত্যু ব্যবসায়ী বিলাইগেটুর ঘরণী হব না। বাড়ি চলো, বাবা। আমাদের পাড়াতেই থাকে কিটু। খুব ভাল ছেলে। আমাকে সুখে রাখবে। চলো বাবা, আমাকে কিটুর সাথেই বিয়ে দেবে।

সুতরাং পুঁটির বাবা মাথা ঝাঁকিয়ে, গোঁফ নাছিয়ে, লেজ নাড়িয়ে পুঁটিকে নিয়ে চললো কিটুর বাড়ি।

তারপর কিটু পুঁটির ধুমধাম করে বিয়ে হল। বিয়ের পর পুঁটি মুচকি হেসে কিটুকে বলেছিল, প্রতি বাড়িতেই ইলিশ আরর পম্ফ্রেটের কথা শুনে বুঝেছিলাম, এ কাজ নির্ঘাত তোমার।

আমার লকডাউনের গল্পটি ফুরোলো, ভারতের নটে গাছটি মুড়োলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *