মৌনমুখরতা

আজকাল “ঈদ” আমার কাছে স্মৃতিচারণার উৎসব। ঘরে বসে নামাজ, মায়ের স্পেশাল কাবাবের ঠিকুজি কুষ্টি বিশ্লেষণ ও নিজের রান্না করা মাংসে প্যাঁচ দিতে, আনপ্রেডিক্টেবল মশলা ঢালার নাম ঈদ হয়ে গেছে।
মাঝেমধ্যে স্মৃতিবিলাসিতা মনখারাপের মধ্যগগনে
“সব ঝুট হ্যায়” বলে হাঁক দিলে, মেহেন্দির কিছু গড়িমসি চালও রয়ে যায় হাতে। গন্ধ থাকে তিনদিন। এই তিনদিন আমি ছোটবেলার টুকরো কাঁচ দেখি। লাল বড় উঠোন, উনুনচালার ধোঁয়া,দাদাজির একটা লম্বা লাঠি, দাদিজির গায়ের গন্ধ আর একটা হুল্লোড়প্রিয় বাড়ি ও পাড়া। পাড়ায় পাড়ায় সিমুইয়ের কারসাজি। মিষ্টি খেতে খেতে গলায় মিষ্টির আস্তরণ পড়ে গেলে বড়মা বাটি করে গোস্তের টিকিয়া দিত। মা-কাকিমা-ছোটমারা জোগাড় করত। বাড়ির অন্য বউরা রান্না করলে কেউ কেউ খুঁতখুঁত করে উঠলেও, আমার মায়ের বেলায় ট্যাঁ পোঁ -এর লেশমাত্র নেই। প্রয়োজনীয় উপাদান না পেয়েও মা উপাদানে জোড়াতাপ্পি দিয়ে বিরিয়ানি বানাত।সবাই উল্লাস করে খেত।

ঈদের দিনও দাদাজি ভাতের সঙ্গে জিরে দেওয়া পাতলা ঝোল খেতেন। ঝোলের বাটিটা আমি বায়না করে নিয়ে যেতাম। বাড়ি গেলে ঐ ডিপার্টমেন্ট ছিল আমার। এই ছোট্ট একটা কাজের জন্যও দাদাজি কোলে বসিয়ে বলতেন- ” তুই একখানা হবি”। সারা দিন পাড়া বেড়িয়ে দাদা দিদিদের সাথে টো টো করে করে বাড়ি ফিরলে পাপা ডেকে নিয়ে যেত দাদাজির ঘরে। নিজের কোলে দাদাজির পা তুলে সরষের তেল দিয়ে মালিশ করে দিত। দেখাদেখি আমিও নকল করতাম, দাদাজির আর এক পা নিয়ে। দাদাজি রাগ করতেন। পাপা বলত-” আব্বা করুক না। আপনি দোয়া করুন”। দাদাজি গল্প করতে করতে দোয়া করতেন, শেষে বলতেন- ” তুই একখানা হবি”। আমাকে ছোটবেলায় বলা হত দাদাজির দোয়া যখন পেয়েছি, আমি অনেক বড় হব। তখন থেকে আমিও তাই ভাবতাম । কিন্তু বড় হয়ে “একখানা হওয়ার” অর্থ সম্পূর্ণ করে বুঝলাম যেদিন, সেদিন দেখেছি- এই কথাগুলো আমার আশ্রয় হয়ে গিয়েছে। জীবনের প্রতিটা লাঞ্চনায়, অপমানে, পরাজয়ে। জীবন আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে জানিনা। তবে এই কথাগুলো আমাকে টেনে নিয়ে যায় খরস্রোতার দিকে। ভাঙাচোরাকে ভয় পাওয়ার আগে সাহস জোগায়।সব্বাই আমার উপর থেকে বিশ্বাস ছেড়ে দিলেও শব্দগুলো আমায় গার্ডেন এঞ্জের মতো নিয়ে যায় আলোর দিকে। পথ দেখায়, ঘরে ফেরার।

দাদাজি দাদিজি চলে যাওয়ার পর দেশের বাড়ির মোহ কেটে যায়। যেই আমি ঈদে বাড়ি না যাওয়া হলে কাঁদতাম, সেই আমি এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। বাড়িতেও দ্বন্দ্ব বিরোধের দৌলতে ভাই- ভাইয়ের তিক্ততায় মলিন হয়েছে, ঈদের উন্মাদনা। আজকাল ভিডিওকল করে কথা বলি প্রিয়জনদের সাথে, দূর থেকে একে অপরকে ঈদের সালাম জানানোর সময় কেঁদে ফেলে বাড়ির লোক। এই ঈদে কান্নাগুলো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। তিন সপ্তাহ আগে আমাদের ছোট বেটিকে কেড়ে নিয়েছে করোনা। শেষ দেখাটুকুও ফোনে, পি.পি.ই -এর উপর কাফন। মুখ ঢাকা শিল্ডে। প্রিয়জনের শেষদেখাটুকুও ভার্চুয়াল হয়ে গিয়েছে। ফোনকে আগে বোকাবাক্সেরই আনুষঙ্গিক মনে হত, এখন বিষবাক্স মনে হয়। নির্ভরতা নিতে অপমান বোধ করি, নির্ভর হয়ে শোকগুলোকে গোগ্রাসে গিলি। এত শব্দ ভালো লাগে না। শব্দহীনতার কাছে যাওয়ার উপায় খুঁজি। তায় সবশেষে স্মৃতির শোকেসে এসে মাথা নত করি। তাকে সোহাগ করি। আমার ঈদের স্মৃতি অনন্ত মৌনের সুন্দর প্রতীক। স্মৃতি আমায় নিয়ে যায় মৌনমুখরতায়।

রাকিবা,ঈদ ২০২১.

One thought on “মৌনমুখরতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *